schema:text
| - সম্প্রতি অনলাইন ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ঢাকা প্রকাশ “রাজধানীর মিরপুরে দেখা মিলল রাসেলস ভাইপারের” দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ফটোকার্ড প্রকাশ করে৷ ফটোকার্ডটিতে একটি সাপের ছবিও ফিচার করা হয়৷
তবে, বিস্তারিত সংবাদ পড়লে সেখানে ভিন্ন একটি সাপের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। বিস্তারিত সংবাদে দাবি করা হয়, “শাহ আলী থানার এসআই শাহিদুল ইসলামের চিড়িয়াখানা রোডের বাসার বাথরুমে রাসেলস ভাইপারের একটি বাচ্চা দেখা যায়। পরে সাপটি পিটিয়ে মারা হয়। এ সময় শাহিদুল থানায় ডিউটিতে ছিলেন।” এ বিষয়ে এসআই শাহিদুল ইসলাম বলেন, “সকালে ডিউটিতে থাকা অবস্থায় আমার স্ত্রী ফোন করে বলে বাথরুমে একটি সাপের বাচ্চা দেখে পিটিয়ে মারা হয়েছে। আমি সাপের ছবি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাতে বলি। সাপ দেখে মনে হলো এটি রাসেলস ভাইপারের বাচ্চা। দেখতে হুবহু রাসেল ভাইপারের মতো। পরিচিত অনেকে দেখে নিশ্চিত হয়েছেন এটি রাসেলস ভাইপার। সাপের ছবি ফেসবুকে দেওয়ার পর অনেকে রাসেল ভাইপার বলে নিশ্চিত করেছেন।” ঢাকা প্রকাশ ছাড়াও বাংলা মিডিয়া নামের অন্য একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমে হুবহু একই দাবি প্রচার হতে দেখা যায়৷ এছাড়া, মূলধারার গণমাধ্যম দৈনিক যুগান্তর “এবার রাজধানীতে রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক” শিরোনামে এই বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে যেখানে তারা দাবি করে, “সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় মিরপুর ১ নম্বর চিড়িয়াখানা রোডের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে রাসেলস ভাইপার সদৃশ একটি সাপ মারা হয়। এ ঘটনার পর ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। জানা যায়, শাহ আলী থানার এসআই শাহিদুল ইসলামের চিড়িয়াখানা রোডের বাসার বাথরুমে রাসেলস ভাইপারের একটি বাচ্চা দেখা যায়। পরে সাপটি পিটিয়ে মারা হয়। এ সময় শাহিদুল থানায় ডিউটিতে ছিলেন।” এক্ষেত্রে হত্যাকৃত সাপের একই ছবি দৈনিক যুগান্তর ও ঢাকা প্রকাশ তাদের ওয়েবসাইটে প্রচার করে।
উক্ত সংবাদের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদ দেখুন : দৈনিক যুগান্তর, ঢাকা প্রকাশ এবং বাংলা মিডিয়া।
উক্ত ঘটনাটির সংবাদের ফটোকার্ডে সাপটি রাসেল’স ভাইপার দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত ফটোকার্ড দেখুন: ঢাকা প্রকাশ, বাংলা মিডিয়া।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুরে হত্যাকৃত যে সাপটিকে তীব্র বিষধর সাপ রাসেল’স ভাইপার দাবিতে সংবাদমাধ্যমের ফটোকার্ড প্রচার করা হচ্ছে, তা প্রকৃতপক্ষে নির্বিষ ঘরগিন্নি বা ঘরচিতি সাপ। তবে আলোচিত দাবির ফটোকার্ডে ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত আসল রাসেল’স ভাইপারের ছবিই ব্যবহার করা হয়েছে।
বিস্তারিত সংবাদে বলা হয়, “সোমবার (১ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টায় মিরপুর ১ নম্বর চিড়িয়াখানা রোডের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে রাসেলস ভাইপার সদৃশ একটি সাপ মারা হয়েছে। এদিকে এ ঘটনার পর ওই এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। জানা গেছে, শাহ আলী থানার এসআই শাহিদুল ইসলামের চিড়িয়াখানা রোডের বাসার বাথরুমে রাসেলস ভাইপারের একটি বাচ্চা দেখা যায়। পরে সাপটি পিটিয়ে মারা হয়। এ সময় শাহিদুল থানায় ডিউটিতে ছিলেন।”
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে বিস্তারিত সংবাদ প্রতিবেদনে সংযুক্ত হত্যাকৃত সাপটির ছবি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। সাপটির গঠন ও বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে সাপটির সাথে তীব্র বিষধর সাপ রাসেল’স ভাইপারের গঠন ও বৈশিষ্ট্যের মিল পাওয়া যায়নি বরং পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। রাসেল’স ভাইপারের বৈজ্ঞানিক নাম Daboia russelii এবং রাসেল’স ভাইপারের মাথার আকৃতি ত্রিকোণাকার এবং রাসেল’স ভাইপারের গায়ে স্পষ্ট গোলাকার অনেকটা চেইনের মতো দাগ থাকে৷ তাছাড়া, বাংলাদেশে প্রাপ্ত রাসেল’স ভাইপারে সাধারণত উজ্জ্বল আকৃতির বাদামি বর্ণের মধ্যে স্পষ্ট গোলাকার দাগ থাকে। উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচিত দাবিতে প্রচারিত সাপটির সাথে মিলে না।
উল্লেখ্য, উক্ত বৈশিষ্ট্য ঢাকা প্রকাশ এবং বাংলা মিডিয়ার ফটোকার্ডে ব্যবহৃত সাপের ছবির সাথে মিলে। অর্থাৎ, ফটোকার্ডে ফিচার করা সাপটি তীব্র বিষধর রাসেল’স ভাইপার। কিন্তু, ফটোকার্ডে ফিচার করা সাপ এবং সংবাদ প্রতিবেদনে দেখানো হত্যাকৃত সাপের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখ্য, ঢাকা প্রকাশ তাদের ফিচারে ব্যবহৃত সাপের ছবি মূল সংবাদে সংগৃহীত বলে উল্লেখ করেছে।
অপরদিকে প্রচারিত সাপটির সাথে নির্বিষ ঘরগিন্নি বা ঘরচিতি সাপের মিল পাওয়া যায়। ঘরগিন্নি বা ঘরচিতি সাপকে ইংরেজিতে Indian Wolf snake বা Common Wolf Snake বলা হয়ে থাকে। নানারকম প্রাণীর বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করা প্ল্যাটফর্ম অ্যানিম্যালিয়ার নিবন্ধ অনুসারে, সাপটির বৈজ্ঞানিক নাম Lycodon aulicus. সাপটি নির্বিষ এবং এদেরকে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় পাওয়া যায়৷ এটি একটি নির্বিষ সাপ যার রঙ পরিবর্তনশীল। এর নামের লাইকোডন গ্রিক শব্দ λύκος (lykos) থেকে এসেছে যার অর্থ নেকড়ে এবং οδόν (odon) যার অর্থ দাঁত। এটি এই প্রজাতির নেকড়ের মতো সামনের ম্যাক্সিলারি এবং ম্যান্ডিবুলার দাঁতের দিকে ইঙ্গিত করে। এদেরকে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, মিয়ানমারে পাওয়া যায়।
উদ্ভিদ এবং প্রাণী শনাক্তকরণে সাহায্য করা প্ল্যাটফর্ম iNaturalist এর নিবন্ধ অনুসারে, এরা নির্বিষ।
গৃহের আশেপাশে সাধারণত দেখা যায়, টিকটিকি দ্বারা আকৃষ্ট হয়। লম্বা, তীক্ষ্ণ নেকড়ের মতো সামনের দাঁতের জন্য এদের এরকম নামকরণ করা হয়েছে। এরা ছোট, সরু সাপ, আঁশ মসৃণ এবং পেট সাদা অচিহ্নিত। রঙ সাধারণত ধূসর বাদামি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে কালোও হতে পারে। প্রায়শই সাদা রঙের কিছুটা মোটা ব্যান্ড থাকে, কিছু ব্যান্ড হলদে আভাযুক্ত। এদের মাথা স্বতন্ত্র চ্যাপ্টা এবং গলার চেয়ে প্রশস্ত। চোখ কালো, মণি প্রচ্ছন্ন। এরা বিভিন্ন ঘন বন, খোলা বন, পাথুরে অঞ্চল এবং মানব বসতিতে বাস করে। ফাটল, বড় পাথরের নিচ, গাছের ছাল এবং বাড়ির আশেপাশের ফাঁক-ফোঁকরের মতো শুকনো ও নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে থাকে। দিনের বেলা লুকিয়ে থাকে, রাতের বেলা শিকার খোঁজার জন্য গাছ এবং পাথরে উঠে।
এরা প্রধানত টিকটিকি জাতীয় সরীসৃপ খায়। কখনও কখনও ব্যাঙ ও ইঁদুরও খায়। এরা নিশাচর। এরা সতর্ক থাকে এবং বিপদের মুখোমুখি হলে পালানোর চেষ্টা করে। এরা শরীর পেঁচিয়ে মাথা লুকিয়ে রাখে এবং এই প্রজাতির বড় সাপের কামড় ব্যথাদায়ক হতে পারে।
নানা রকম সাপের তথ্যসমৃদ্ধ অন্য আরেকটি প্ল্যাটফর্ম ইন্ডিয়ান স্নেকসে এই সাপটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটি একটি ছোট-মাঝারি আকারের সাপ যাদের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৫০-৭০ সে.মি. হয়। এদের বাচ্চারা প্রায় ১৪ সে.মি. লম্বা হয়। এর শরীর পরিমিত মোটা, চকচকে মসৃণ আঁশ দিয়ে আবৃত। এর পিঠের রং চকচকে গাঢ় চকোলেট বাদামি বা কালো, সাথে সাদা ব্যান্ড থাকে যা প্রাপ্তবয়স্ক সাপের পিছনের অংশে অনুজ্জ্বল হয়ে যায়। এই ব্যান্ডগুলি পাশের দিকে সবচেয়ে প্রশস্ত এবং উপরে সবচেয়ে সংকীর্ণ হয়। এদের চোখ মাঝারি এবং সম্পূর্ণ কালো দেখায়।
উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে হত্যাকৃত সাপটির মিল পাওয়া যায়৷ যা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় আলোচ্য হত্যাকৃত সাপটি তীব্র বিষধর রাসেল’স ভাইপার নয়, বরং নির্বিষ ঘরগিন্নি বা ঘরচিতি সাপ।
এ বিষয়ে অধিকতর নিশ্চিত হতে রিউমর স্ক্যানার যোগাযোগ করে সাপ ও সাপের উদ্ধার নিয়ে কাজ করা প্ল্যাটফর্ম Snake Rescue Team Bangladesh এর প্রেসিডেন্ট মোঃ রাজু আহমেদ ও জেনারেল সেক্রেটারি প্রিতম সুর রায়ের সাথে৷ উভয়ই আলোচিত দাবিতে প্রচারিত সাপটি রাসেল’স ভাইপার নয়, বরং ঘরগিন্নি সাপ বলে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেন।
মূলত, সম্প্রতি ঢাকার মিরপুরে শাহ আলী থানার এসআই শাহিদুল ইসলামের চিড়িয়াখানা রোডের বাসার বাথরুমে একটি সাপ রাসেল’স ভাইপার সন্দেহে হত্যা করা হয়৷ কিছু দেশীয় গণমাধ্যমও হত্যাকৃত সাপটি রাসেল’স ভাইপার দাবিতে ফটোকার্ড প্রচার করে৷ কিন্তু, রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, হত্যাকৃত সাপটি তীব্র বিষধর সাপ রাসেল’স ভাইপার নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি নির্বিষ ঘরগিন্নি বা ঘরচিতি সাপ।
সুতরাং, ঢাকার মিরপুরে শাহ আলী থানার এসআই শাহিদুল ইসলামের চিড়িয়াখানা রোডের বাসায় হত্যাকৃত সাপটিকে তীব্র বিষধর সাপ রাসেল’স ভাইপার দাবিতে প্রচারিত সংবাদ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Forestry – Russell’s Viper
- Animalia – INDIAN WOLF SNAKE
- iNaturalist – Indian Wolf Snake
- Indian Snakes – Common Wolf Snake ( Lycodon aulicus)
- Statement of Md Raju Ahmed
- Statement of Pritom Sur Roy
- Rumor Scanner’s own analysis
|