schema:text
| - সম্প্রতি বিডি প্যানোরোমা নামের একটি ওয়েবসাইটে ‘কোটায় চাকুরি পেলেন উপদেষ্টা নাহিদের বোন ফাতেমা তাসনিম’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত কথিত এই সংবাদের বিস্তারিত অংশে এক নারীর ছবি ব্যবহার করে তার নাম ফাতিমা তাসনিম উল্লেখ করে দাবি করা হয়, “তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা এবং কোটা আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের বড় বোন ফাতেমা তাসনিম চাকুরি পেয়েছেন বিশেষ বিবেচনায়। ফাতেমা তাসনিমকে কানাডাস্থ বাংলাদেশ মিশনের পাবলিক রিলেশন অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মূলত তাকে কানাডাস্থ বাংলাদেশ মিশনে সম্প্রতি চাকুরিচ্যুত মিথিলা ফারজানার স্থানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ৩ বছরের মেয়াদে ফাতেমা তাসনিম এই চাকুরি পেয়েছেন। তাকে আগামী ১ অক্টোবর কানাডায় জয়েন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়।”
দাবি করা হয়, “ফাতেমা তাসনিম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশে অনার্স ও মাস্টার্স করে মগবাজারে একটি কোচিং সেন্টারে পড়াতেন।”
উক্ত সংবাদের বরাতে ফেসবুকে একই দাবিতে কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)৷
একই দাবিতে ইউটিউবের একটি ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, যে নারীর ছবি ব্যবহার করে আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে তিনি উপদেষ্টা নাহিদের বোন নন এবং তিনি কোনো সরকারি চাকরিও পাননি বরং তিনি গণ অধিকার পরিষদের নেত্রী এবং তার সাথে নাহিদের আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তারা দুইজনই রাজনৈতিক সহকর্মী।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিটির সূত্রপাত অনুসন্ধানে বিডি প্যানোরোমা নামের সাইটটি পর্যবেক্ষণ এবং যাচাই করে রিউমর স্ক্যানার। সাইটটিতে বর্তমানে মাত্র চারটি নিউজ রয়েছে। এর একটি ফাতিমা তাসনিমকে নিয়ে। এই সাইটটির বর্তমান যে সংস্করণ সেটির ডোমেইন ২০২৩ সালের ০৩ আগস্ট রেজিষ্ট্রেশন করা হয়৷ গত ১২ জুলাই সর্বশেষ আপডেট হওয়া ডোমেইনটির মেয়াদ ২০২৫ সালের ০৩ আগস্ট পর্যন্ত রয়েছে। তবে সাইটটির অস্তিত্ব পাওয়া যায় ২০১৫ সাল থেকে৷ সে সময় থেকেই নিয়মিত এই সাইটে মনগড়া সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। সেগুলো পরে আবার সরিয়েও নেওয়া হয়। সে বছরই একই নামে একটি ফেসবুক পেজও খোলা হয়। পেজটি বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে একজন এবং যুক্তরাজ্য থেকে দুইজন অপারেট করছেন৷
এই পেজটি ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে বেশ সচল দেখা যায়। সাইটের অনেক লিংক শেয়ার করা হয় সে সময়। ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি পোস্ট দিলেও গত দুইদিন আগে থেকে নতুন করে সচল করা হয়েছে পেজটি। ফাতিমা তাসনিমের বিষয়ে কথিত নিউজটির লিংকও শেয়ার হয়েছে।
এই সংবাদে বেশ কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে। যেমন দাবি করা হচ্ছে, ফাতেমা তাসনিমকে কানাডাস্থ বাংলাদেশ মিশনের পাবলিক রিলেশন অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মূলত তাকে কানাডাস্থ বাংলাদেশ মিশনে সম্প্রতি চাকুরিচ্যুত মিথিলা ফারজানার স্থানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ৩ বছরের মেয়াদে ফাতেমা তাসনিম এই চাকুরি পেয়েছেন। তাকে আগামী ১ অক্টোবর কানাডায় জয়েন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। কিন্তু এসব কথিত তথ্যের বিপরীতে কোনো সূত্র বা প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি। নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। তবে এই সংবাদে সে বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। উল্টো দাবি করা হচ্ছে, ফাতিমাকে কানাডায় যোগ দিতে নির্দেশনা দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এই সাইট এবং এর ফেসবুক পেজের কন্টেন্ট বিশ্লেষণে রিউমর স্ক্যানারের কাছে এটিকে ভুঁইফোঁড় সাইট বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার পরবর্তীতে কথিত সংবাদে উল্লিখিত তথ্যগুলো যাচাই করে। শুরুতে ছবিটি রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখা যায়, ২০২৩ সালের আগস্টে গণঅধিকার পরিষদের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ যুব অধিকার পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দেওয়া গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের সদস্য ফাতিমা তাসনিমের বক্তব্যের ফুটেজ এটি।
গত ১৪ আগস্ট প্রকাশিত ফাতিমার একটি বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ থেকে জানা যায়, তার জন্ম পটুয়াখালীতে। অন্যদিকে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, নাহিদের জন্ম ঢাকার অদূরে ফকিরখালীতে। ফাতিমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বিশ্লেষণ করে নাহিদের সাথে তার আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকার কোনো প্রমাণ মেলেনি। ফাতেমা রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছেন, এটা পুরোটাই একটা ভুয়া নিউজ। এর সাথে বাস্তবে কোন সত্যতা নেই। তাছাড়া, জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো নাহিদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছে। তিনিও জানিয়েছেন, “ফাতিমা তাসনিম নামের এই নারী আমার পরিবারের কেউ নন। তাঁর সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগও নেই।”
পরবর্তী অনুসন্ধানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ফাতিমার কথিত এই নিয়োগের বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন দিয়েছে কিনা তা জানতে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের সংশ্লিষ্ট শাখায় সম্প্রতি এমন কোনো প্রজ্ঞাপনের তথ্য মেলেনি। কানাডার অটোয়া হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার দেওয়ান হোসনে আইয়ুব রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, তারাও এ বিষয়ে কিছু জানেন না।
দাবি করা হচ্ছিল যে ফাতিমাকে কানাডাস্থ বাংলাদেশ মিশনের পাবলিক রিলেশন অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু মিশনের অটোয়া এবং টরন্টোর ওয়েবসাইটে এমন কোনো পদের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, তাকে কানাডাস্থ বাংলাদেশ মিশনে সম্প্রতি চাকুরিচ্যুত মিথিলা ফারজানার স্থানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে দাবি করা হলেও মিথিলার পদটি পাবলিক রিলেশন অফিসারের নয়, ছিল হাইকমিশনে কাউন্সেলর। হাইকমিশন সূত্রেও আলোচিত এই নিয়োগের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে একই সংবাদে ফাতিমা তাসনিম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্নের দাবি করা হলেও ফাতিমার অ্যাকাউন্টে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ নেই। ফাতিমা নিজেও রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, “আমি এই ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা করিনি। সবকিছুই অসত্য ও মিথ্যা।”
তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বিভাগে সান্ধ্যাকালীন মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে ২০২০ সালে কোর্সটি শেষ করেন৷ এর আগে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ এনং সিদ্ধেশ্বরী ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়াশোনার তথ্য পাওয়া যায় তার অ্যাকাউন্টে।
অর্থাৎ, বিডি প্যানোরোমা নামের একটি ভুঁইফোড় সাইটে গণপরিষদ নেত্রী ফাতিমা তাসনিমের ছবি ব্যবহার করে তাকে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের বোন বলে দাবি করা হলেও আদতে তাদের মধ্যে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। ফাতিমা কানাডার বাংলাদেশ মিশনে চাকুরিও পাননি। এমনকি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি পড়াশোনা করেননি।
তবে ফাতিমা তাসনিম নামে নাহিদের একজন বড় বোন থাকার দাবি পাওয়া যাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির বরাতে হওয়া সংবাদে। গত ২৬ জুলাই বিবিসি সংস্থাটির বরাত দিয়ে জানায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বকর মজুমদারকে সাদা পোশাকে ছয়জন তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেছেন নাহিদের বড় বোন ফাতেমা তাসনিম।
এ বিষয়ে সেসময় দেশি-বিদেশি একাধিক গণমাধ্যমেই সংবাদ প্রকাশিত হয়। দেখুন ডয়চে ভেলে বাংলা, দ্য ডেইলি স্টার, ইত্তেফাক, কালের কণ্ঠ, আমার বার্তা।
বিষয়টি নিয়ে অধিকতর অনুসন্ধানে আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে ফাতিমাকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়৷ বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই নারীই গণঅধিকার পরিষদের নেত্রী ফাতিমা তাসনিম।
ফাতিমা তাসনিম এ বিষয়ে রিউমর স্ক্যানারকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ২১ জুলাই যখন নাহিদকে মেরে পূর্বাচলে ফেলে রেখে যাওয়া হয় তখন তাকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আনা হয়। এই হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন কাজের সূত্রে ফাতিমার পরিচিত ছিল। নাহিদকে যখন হাসপাতালে নেওয়া হয়, তখন তার দল থেকে তাকে বলা হয় নাহিদকে ভর্তির ক্ষেত্রে সহায়তা করতে। সে সময় নাহিদের সাথে তার স্ত্রী ছিলেন। বিভিন্ন সংস্থার চাপের কারণে ভর্তি নিতে কালবিলম্ব করায় সে সময় নিজেকে নাহিদের বড় বোনের পরিচয় দিয়ে ভর্তি করান তিনি।
ফাতিমা রিউমর স্ক্যানারকে বলছিলেন, নাহিদকে সহায়তার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সম্পর্কটাকেও প্রাধান্য দিতে চেয়েছেন তিনি। জানান, “আমি গণঅধিকার পরিষদের স্থায়ী কমিটির সদস্য আর ওরা (নাহিদ, আসিফ, তাবাসসুম) আমাদের ছাত্র অধিকার পরিষদের ঢাবি শাখার কমিটিতে ছিল। সেই জায়গা থেকে আমার সাথে বড় বোন ছোট ভাইয়ের একটা সম্পর্ক ছিল শুরু থেকেই। ওদেরকে আমি অনেক স্নেহ করতাম। আবার ইউনিভার্সিটিরও বড় বোন আমি। তো এত এক্সপ্লেইন, আপন বোন না ফুফাতো বোন না সাংগঠনিক বোন ওই সময়টা এত ব্যাখ্যা করার সময় ছিল না। আমার কাছে মনে হয়েছে, ও একজন যোদ্ধা। ও আমার ভাই এবং ওকে বাঁচিয়ে রাখাটা, ট্রিটমেন্টটা প্রথম দরকার। সে জায়গা থেকে আমি বলেছি যে আপনারা ভর্তি নেন, আমি ওর গার্ডিয়ান। ওর ট্রিটমেন্টটা করেন।” গণমাধ্যমেও সেভাবেই নাহিদের সাথে তাকে জড়ানো হয় বলে মনে করছেন গণঅধিকার পরিষদের এই নেত্রী।
ফাতিমা তাসনিম নাহিদ ইসলামের রাজনৈতিক যে পরিচয় উল্লেখ করেছেন তা বিগত কয়েক বছরে নাহিদের রাজনৈতিক কার্যক্রমের সাথে মিল পাওয়া যায়। গত আগস্টে বাংলা ট্রিবিউন জানায়, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন নাহিদ। সেখান থেকে নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ছাত্র অধিকার পরিষদের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন। এ সময় তিনি এই সংগঠনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।
জুলাইতে গণমাধ্যমটি জানায়, গত বছরের শুরু থেকে গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া ও সদস্য সচিব নুরুল হক নুরের দ্বন্দ্বের সময় দল দুই ভাগ হয়ে পড়লে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নুরের অনুসারী হিসেবে পরিচিতদের একটি অংশ ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ গড়ে তোলেন। নাহিদ ইসলাম এই সংগঠনের সদস্য সচিব। বাংলা ট্রিবিউন খোঁজ নিয়ে জেনেছে, নাহিদ ইসলাম বিগত ডাকসু নির্বাচনে নুরুল হক নুরের প্যানেল থেকে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছিলেন। যুগান্তরের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন থেকেও একই তথ্য জানা যায়।
সুতরাং, গণঅধিকার পরিষদের নেত্রী ফাতিমা তাসনিম ও উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে জড়িয়ে ভুঁইফোঁড় একটি সাইটে প্রচারিত দাবিগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Statement from Fatema Tasnim
- Rumor Scanner’s own investigation
|