schema:text
| - সম্প্রতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে নিয়ে একটি গল্প প্রচার করা হয়েছে। যেখানে দাবি করা হচ্ছে, কেরালার মলাপ্পুরম জেলার কালেক্টর শ্রীমতী রানী সোয়ামই এখন ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মু। অভ্র খনিতে কাজ করার সময় তার বাবা, মা, দুই ভাই ও বোনের মৃত্যু হওয় এবং যেহেতু অভ্র দিয়ে সৌন্দর্য্য প্রসাধনী তৈরি হয়, তাই তিনি মেকআপ করেন না।
দেখুন- এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, মেকআপ সংক্রান্ত আলোচিত গল্পটি ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর জীবনকাহিনী নিয়ে লেখা নয়। বরং, প্রকৃতপক্ষে, আলোচিত গল্পের ‘রানী সোয়ামই’ মালায়ালাম লেখক হেকিম মোরায়ুরের লেখা ‘থ্রি উইমেন’ গল্প সংকলনের ‘শাইনিং ফেসেস’ নামক গল্পের একটি কাল্পনিক চরিত্র।
অনুসন্ধানের শুরুতে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে নিয়ে প্রচারিত গল্পটির মূল পয়েন্টগুলো নোট করে রিউমর স্ক্যানার।
গল্পের শুরুতে বলা হয়, ‘কেরলের মলাপ্পুরম জেলার কালেক্টর শ্রীমতী রানী সোয়ামই এক ঝাঁক কলেজ ছাত্রীদের সাথে কথা বলছিলেন। মহিলার কবজিতে সামান্য একটা ঘড়ি ছাড়া অন্য কোন প্রসাধন নেই । ছাত্রীরা দেখে আশ্চর্য্য হয়ে যায়, যে ওনার মুখের ওপরে সামান্য ফেস পাউডারের স্পর্শ মাত্র নেই।’
গল্পে দাবি কর হয়, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর নাম রানী এবং পারিবারিক নাম সোয়ামই । তিনি ঝাড়খণ্ড রাজ্যের কোডারমা জেলার একটি আদিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের তার বড় দুই ভাই এবং এক ছোটবোন। বাবা মা খুবই কম পয়সায় অভ্র খনিতে কাজ করতেন এবং এছাড়া তারা অন্য কোনো কাজ জানতেন না। তাদের বেশিরভাগ দিনই খাবার বলতে জুটতো একটা বা দুইটা রুটি আর ভরপেট জল। সেই অভ্র খনিতে কাজ করার সময় অসুস্থ হয়ে তার দুই ভাই মারা যান । একসময় তাকে তার বাবা অভ্র’র খনিতে কাজ করতে নিয়ে যান । খনিতে দিনে আট ঘণ্টা কঠিন পরিশ্রম করে একবেলা কোনরকমে খাবার জোটানোর মতো পয়সা পেতেন। পরবর্তীতে তার ছোট বোনও খনিতে কাজ নেয়।
দাবি করা হয়, তার বয়স যখন দশ বছর তখন বৃষ্টির পানিতে অভ্র খনি ধ্বসে হাজার হাজার শ্রমিকের সাথে বাবা, মা ও ছোট বোন সহ গোটা পরিবারের সকল সদস্যদের মৃত্যু হয়। সেদিন তিনি অসুস্থতার কারনে খনিতে যেতে পারেননি। পরিবারের সকল সদস্যকে হারানের পর তিনি একটি সরকারি মন্দিরে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখান থেকেই শিক্ষার শুরু হয় এবং একসময় কেরালার মলাপ্পুরম জেলার কালেক্টর হন।
আরও দাবি করা হয়, তিনি পড়াশুনার এক পর্যায়ে জানতে পারেন ছোটবেলায় বিপজ্জনক ছোট ছোট অন্ধকার গুহার ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যে অভ্রক তিনি তুলে আনতেন সেগুলো মেকআপ সামগ্রী তৈরীতে ব্যবহার করা হয়। কসমেটিকস্ কম্পানিগুলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত করে ছোট ছোট বাচ্চাদের দিয়ে অভ্রর খনিতে কাজ করানের জন্য এবং যেহেতু অভ্র খনিই তাঁর পরিবারের সকল সদস্যকে কেড়ে নিয়েছে তাই তিনি আর মেকআপ করেন না।
এসব দাবির সত্যতা যাচাইয়ে গুগলে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে প্রাপ্ত TIMESOFINDIA এর ২০২২ সালের ২৫ জুলাই ‘Draupadi Murmu: Lesser known facts about the 15th President of India’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন ও ভারতের রাষ্ট্রপতি দপ্তরের সরকারি ওয়েবসাইটে দ্রৌপদী মুর্মুর প্রোফাইল থেকে জানা যায়, দ্রৌপদী মুর্মু স্বাধীন ভারতে জন্মগ্রহণকারী প্রথম রাষ্ট্রপতি। দেশের প্রথম আদিবাসী ও প্রতিভা দেবীসিংহ পাটিলের পর দেশের দ্বিতীয় নারী যিনি এই পদে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ১৯৫৮ সালের ২০ জুন ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার উপরবেদা গ্রামে একটি সাঁওতাল আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত বিরাঞ্চি নারায়ণ টুডু নামে এক কৃষকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।
জানা যায়, তিনি গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ওডিশার ভুবনেশ্বরের রমাদেবী মহিলা কলেজ (রমাদেবী বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি কলেজ শিক্ষা অর্জনকারী তাঁর গ্রামের প্রথম মহিলা। রাজনীতিতে প্রবেশের আগে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ওড়িশার সেচ ও বিদ্যুৎ বিভাগে জুনিয়র সহকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে, তিনি রায়রংপুরের শ্রী অরবিন্দ ইন্টিগ্রাল এডুকেশন সেন্টারে অবৈতনিক শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। যেখানে তিনি শিক্ষার্থীদের হিন্দি, ওড়িয়া, গণিত এবং ভূগোল বিষয় পড়াতেন।
আরও জানা যায়, ১৯৯৭ সালে রায়রংপুর নগর পঞ্চায়েতের কাউন্সিলর হিসেবে রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। তিনি ভারতীয় জনতা পার্টিতে (বিজেপি) যোগ দিয়েছিলেন এবং ২০০০ সালে তিনি রায়রাংপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ওড়িশা বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হন এবং ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই সময়কালে, তিনি ৬ মার্চ, ২০০০ থেকে ৬ আগস্ট, ২০০২ পর্যন্ত ওড়িশা সরকারের বাণিজ্য ও পরিবহন বিভাগের প্রতিমন্ত্রী (স্বাধীন দায়িত্ব) এবং ৬ আগস্ট, ২০০২ থেকে ১৬ ই মে, ২০০৪ পর্যন্ত ওড়িশা সরকারের মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ উন্নয়ন বিভাগের প্রতিমন্ত্রী (স্বাধীন দায়িত্ব) হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ২০১৫ সালের মে মাস থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল ছিলেন। তিনিই প্রথম নারী যিনি এই পদে অধিষ্ঠিত হন।
অর্থাৎ, টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন ও রাষ্ট্রপতি দপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে এটি স্পষ্ট যে দ্রৌপদী মুর্মু ওড়িশাতে জন্মগ্রহণ করেন, ঝাড়খণ্ডে নয়। এবং তিনি মলাপ্পুরম কিংবা অন্য কোনো জেলার কালেক্টেরও ছিলেন না।
পরবর্তীতে দ্রৌপদী মুর্মুর পরিবার সম্পর্কে জানতে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে HindustanTimes এর ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ২১ জুলাই ‘When Droupadi Murmu lost her husband, 2 sons | 5 things to know about her family’ শিরোনামের প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে তিনি স্বামী, দুই ছেলে, মা ও ভাইকে হারিয়েছেন। ২০০৯ সালে তার এক ছেলে রহস্যজনকভাবে মারা যায়। ২০০৯ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, লক্ষ্মণ মুর্মু (২৫) নামে ওই যুবককে তাঁর বিছানায় অচৈতন্য অবস্থায় পাওয়া যায়। ২০১২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় দ্বিতীয় ছেলে মারা যান। ২০১৪ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর স্বামী শ্যাম চরম মুর্মু মারা যান। বর্তমানে ইতিশ্রী মুর্মু নামে তাঁর এক মেয়ে আছেন। ইতিশ্রী মুর্মু একটি ব্যাঙ্কে চাকরি করেন এবং রাগবি খেলোয়াড় গণেশ হেমব্রমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
এছাড়া, jagranjosh নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ২০ জুন ‘Draupadi Murmu Biography: Birthday, Family, Daughter, Husband, Education Qualification, Previous Offices and Other Details’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে জানা যায়, দ্রৌপদী মুর্মু ১৯৫৮ সালের ২০ জুন ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার উপরবেদা গ্রামে এক সাঁওতালি আদিবাসী পরিবারে বিরাঞ্চি নারায়ণ টুডুর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ও ঠাকুরদা পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থার অধীনে গ্রাম প্রধান ছিলেন।
BBC এর ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ২৫ জুলাই ‘Droupadi Murmu: India’s first tribal president takes oath’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকেও দ্রৌপদী মুর্মু গ্রাম পরিষদের প্রধানের মেয়ে বলে জানা যায়।
অর্থাৎ, উপরোল্লিখিত তথ্যপ্রমাণ থেকে এটা নিশ্চিত যে দ্রৌপদী মুর্মুর পরিবারের কেউ অভ্র খনিতে কাজ করতেন না। তার বাবা তার বাবা ও ঠাকুরদা পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থার অধীনে গ্রাম প্রধান ছিলেন।
অর্থাৎ, অনুসন্ধানে এই পর্যায়ে এসে এটা স্পষ্ট যে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে নিয়ে প্রচারিত গল্পটি সত্য নয়।
পরবর্তীতে, মালাপ্পুরম জেলার কোনো জেলাশাসকের নাম ‘রানী সোয়ামই’ আছেন কিনা জানতে মালাপ্পুরম জেলার জেলাশাসকের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষণ করে রানী সোয়াময়ই নামে কোনো কালেক্টরের নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, এটাও স্পষ্ট যে এই প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি ‘রানী সোয়ামই’ নামে মালাপ্পুরম জেলার কোনো জেলাশাসক ছিলেন না।
পরবর্তীতে প্রচারিত গল্পের সূত্রপাত খুঁজতে ভিন্ন ভিন্ন কি-ওয়ার্ড সার্চ করে TIMESOFINDIA এর রিডার্স ফোরামে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে ভাইরাল পোস্টের মতো একই গল্প বর্ণনা করা হয়েছে। নিবন্ধটির মন্তব্যের ঘরে মন্তব্যকারীর উল্লেখ করেন গল্পটি কাল্পনিক এবং ‘রানি সোয়াময়ী’ মালায়ালাম লেখক হেকিম মোরায়ুরের একটি মালায়ালাম ছোট গল্প সংকলনের একটি কাল্পনিক চরিত্র।
প্রতিবেদনটি থেকে পাওয়া ক্লু নিয়ে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে ২০২২ সালের ২৪ জানুয়ারি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে মালায়ালাম লেখক হেকিম মোরায়ুরের একটি পোস্ট পাওয়া যায়।
তিনি লিখেছেন, ‘আমার জানা মতে অনেকে আমার ‘থ্রি উইমেন’ নামের গল্পের সংকলন থেকে ‘শাইনিং ফেসেস’ গল্পটি নিয়ে কয়েকজন মহিলার ছবি দিয়ে নিজের মতো করে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এটি কেবল আমার লেখা একটি গল্প। অনেকে মনে করেন আমার রানি সোয়াময়ী নামের নায়িকা একজন প্রকৃত জেলা প্রশাসক। দয়া করে জানানো হল যে, এই বিষয়ে যে কোন সমস্যা দেখা দিলে আমি দায়ী নই… আমার লেখা ও আমার নামে প্রকাশিত একটি বইয়ের গল্পকে এভাবে অপব্যবহার হতে দেখে সত্যিই দুঃখিত।”
মূলত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে নিয়ে একটি গল্প প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, তিনি ‘রানী সোয়াময়ই’ নামে মালাপ্পুরম জেলার কোনো জেলা শাসক ছিলেন। তিনি ঝাড়খণ্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবারের সবাই অভ্র খনিতে কাজ করতেন এবং তার বয়স যখন দশ বৎসর তখন সেই অভ্র খনি ধ্বসে তার পরিবারের সবাই মারা যান। তবে, রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর জন্ম ওডিশাতে জন্ম গ্রহণ করেন এবং তার পরিবারের কেউ খনিতে কাজ করতেন না। তার বাবা পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থার অধীনে গ্রাম প্রধান ছিলেন। এবং দ্রৌপদী মুর্মু কোনো জেলার কালেক্টরও ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে, মালায়ালাম লেখক হেকিম মোরায়ুরের লেখা ‘থ্রি উইমেন’ গল্প সংকলনের ‘শাইনিং ফেসেস’ নামক গল্পের একটি কাল্পনিক চরিত্রকে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর গল্প বলে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে।
সুতরাং, মালায়ালাম লেখক হেকিম মোরায়ুরের লেখা ‘থ্রি উইমেন’ গল্প সংকলনের ‘শাইনিং ফেসেস’ নামক গল্পের একটি কাল্পনিক চরিত্রের জীবনকাহিনীকে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর জীবনকাহিনীর গল্প দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- TIMESOFINDIA: ‘Draupadi Murmu: Lesser known facts about the 15th President of India’
- President of india: Profile
- HindustanTimes: ‘When Droupadi Murmu lost her husband, 2 sons | 5 things to know about her family’
- Jagranjosh: ‘Draupadi Murmu Biography: Birthday, Family, Daughter, Husband, Education Qualification, Previous Offices and Other Details’
- BBC: ‘Droupadi Murmu: India’s first tribal president takes oath’
- District Administration: Malappuram
- TIMESOFINDIA: Born with a horoscope
- Facebook Post: ഹക്കീം മൊറയൂർ
- Rumor Scanner’s Own Analysis
|